বাংলাদেশে জমি ক্রয় করার গাইডবুক

বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে দিন দিন বেড়ে চলেছে তারই ফলস্বরুপ মানুষের থাকা-খাওয়ার এবং কাজের জায়গার অভাব তীব্রতর হচ্ছে। থাকার জন্য যদিও এ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা এবং দরকার দুটোই বাড়ছে কিন্তু এখনো অনেকেই নিজের একটি ছোট ছিমছাম বাড়ী বানিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখে থাকেন।
নিজের আপন একটি বাড়ি বানানোর পিছনের কারণটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। বাড়ি ক্রয় করা বা তৈরী করা যদিও অনেক খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার কিন্তু নিজের বাড়িতে যেই স্বাধীনতা তা অমূল্য। নিজের মত করে নিজের বসবাসের জায়গাটিকে বিনা বাধায় সাজিয়ে নেওয়া যায় এবং ভাড়া বাসার মত বাড়িওয়ালার কোন অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া নিজের গোপনীয়তাও রক্ষা হয় এবং সেই সাথে উওরাধিকার সূত্রে জেনারেশন থেকে জেনারেশন একই বাড়ির সীমানার মধ্যে গড়ে উঠে।
আপনার স্বপ্নের বাড়ি বানাতে প্রথমেই দরকার জমি। আর যেকোন জমি ক্রয় করা যেমন অনেক ব্যয় সাপেক্ষ তেমনি পুরো প্রক্রিয়াটিতে ছোট বড় নানান ধরণের কাজ থাকে যার একটা তালিকা করা না থাকলে খুব সহজেই খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। যেমন- জমির আসল দামের সাথে আনুষাঙ্গিক যেসব খরচাপাতি করতে হয়, কোথায় কীভাবে দলিলপ্ত্র প্রস্তুত করা যায়, রেজিস্ট্রেশন কীভাবে করতে হবে ইত্যাদি। এজন্য আগে থেকেই কাজের একটি তালিকা তৈরী করে নিলে তা অনেকটা গাইডের মত কাজ করে।
এই আর্টিকেলটিতে তাই আপনাদের সুবিধার্থে জমি কেনার সাথে জড়িত কাজগুলোর একটি প্রাথমিক তালিকা তুলে ধরা হলো। তাহলে দেরী না করে চলুন জেনে নেওয়া যাক, জমি কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে-
সূচিপত্রঃ
বাজেট নির্ধারণঃ
জমি কেনার আগে প্রথমে যা করতে হবে তা হচ্ছে, আপনার বাজেটের পরিমাণ নির্ধারণ করা। আগে থেকে বাজেট তৈরি করে নিলে আপনার দুটি সুবিধা হবে, প্রথমত হচ্ছে, আপনি আপনার সামর্থ অনুযায়ী কোন ধরণের জমি কিনতে পারবেন তা নির্দিষ্ট করতে পারবেন এবং দ্বিতীয়ত, আপনার বাজেট অনুযায়ী কোন লোকেশনে জমি কেনা সবচেয়ে উপযোগী হবে সেটাও বুঝতে পারবেন। সাধারণত, জমির মূল্য এর অবস্থানের জায়গার উপর অনেকখানি নির্ভর করে। এছাড়াও বাজেট তৈরির সময় শুধুমাত্র জমি/বাড়ি/এ্যাপার্টমেন্টের দাম হিসাব করলেই হবেনা বরং সেই সাথে ভবিষ্যতে আনুষাংগিক যেসব খরচাপাতির আবির্ভাব ঘটতে পারে সেসবের কথাও মাথায় রাখতে হবে। যেমন- মেরামত, অলটারেশন, মেইন্টেনেন্স খরচসহ আরো অন্যান্য খরচাপাতি।
লোকেশন নির্ধারণঃ
বাজেট তৈরির পরবর্তী কাজ হচ্ছে, বাজেট অনুযায়ী জমির লোকেশন নির্ধারণ করা। ঢাকা দেশের রাজধানী এবং ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র হওয়ায় এখানে অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় ঢাকায় জমিতে ইনভেস্টমেন্ট অনেক বেশি করতে হয়। অন্যদিকে শহরের ভেতরে, গুলশান, বনানী এসব এলাকাগুলোতে জমির দাম অন্য এলাকা যেমন- উওরা, বসুন্ধরা থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। তাছাড়া জমি কেনার পূর্বে লোকেশনের সুযোগ অসুবিধাগুলো (যেমন- জমি-জমার মূল্যের পরিমাণ, অন্যান্য সুবিধা, যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা) সম্পর্কে খবর নিয়ে নিতে হবে। এতে করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।
জমির খোঁজ শুরু করাঃ
বাজেট এবং লোকেশন নির্ধারণ করা হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী জমির খোঁজ শুরু করে দিতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় চাইলে নিজে গিয়ে ঘুরে ফিরে জমির খোঁজ খবর নিতে পারেন নতুবা ঘরে বসেই বিভিন্ন জমির ওয়েবসাইট থেকেও খুব সহজে খবরাখবর নিতে পারবেন। এছাড়া, চাইলে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্যও নিতে পারেন যে আপনাকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারবেন।
নিজস্ব তদারকিঃ
পছন্দসই জমি পাওয়ার পরে সেগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করে ফেলুন। এতে করে পরে গিয়ে সবদিক বিবেচনা করে খুব অল্প সময়ে সেরা জমিটি বাছাই করে ফেলতে পারবেন খুব সহজে। নির্দিষ্ট জমি ঠিক করে ফেলার পরে ক্রেতা হিসেবে আপনার করণীয় হবে স্বশরীরে জমিটি দেখে এর বর্তমান অবস্থা, মালিকানা এসব বিষয়ে বিস্তারিত জেনে আসা যেনো পরে গিয়ে কোন ধরণের ফ্রডের স্বীকার হতে না হয়। নিজে গিয়ে জমি দেখে আসার আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে বিক্রেতার সাথেও কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠে ফলে জমির বিষয়ে যেকোন তথ্য সরাসরি জেনে আসতে পারবেন।
ভূমি অফিস থেকে জমিটির মালিকানা সম্পর্কে জানা-
বাংলাদেশে, ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা সব ধরণের জমির মালিকানার তথ্যাদি এবং জমির রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্য সব আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে থাকে। জমি ব্যবস্থাপনার অফিসে জমির জরিপ, নথিপ্ত্র, প্রকাশনা এবং জমির রক্ষনাবেক্ষণ সম্পর্কিত সকল তথ্য ভূমি মন্ত্রনালয়ের অধীনে পর্যবেক্ষনে রাখা হয়। ভূমি মন্ত্রনালয়ের অধীনে ভূমি রাজস্ব অফিসগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ১১টি প্রশাসনিক অফিস আছে প্রতিটি উপজেলায় এবং ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩টি পার্বত্য জেলা বাদে বাকি ৬১ টি জেলায় ভূমি নিবন্ধন কার্যালয় রয়েছে। ঢাকা শহরে, আইন মন্ত্রনালয়ের অধীনে জেলা ভূমি নিবন্ধনের ১৩ টি কার্যালয় রয়েছে।
জমি সংক্রান্ত তথ্য, জমির দাগ নং, জমির ক্ষতিয়ান ও দরকারি কাগজপত্রের সত্যতা যাচাইঃ
আপনার নির্ধারিত জমিটির বর্তমান মালিক যদি এই জমিটি পূর্বে ক্রয়ের মাধ্যমে মালিকানা নিয়ে থাকেন তাহলে কেনার আগে জমি সংক্রান্ত তথ্য, জমির দাগ নং ও জমির ক্ষতিয়ানের সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। নথিপত্রের সত্যতা যাচাইয়ের পরে সেসব কাগজপত্র বিক্রেতা থেকে ক্ষতিয়ান্রুপে সংগ্রহ করতে হবে। আপনার নিকটবর্তী ডেপুটি কালেকটরের অফিসেই খুব সহজে ক্ষতিয়ান কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে, নিদির্ষ্ট জমির সাম্প্রতিক ক্ষতিয়ানগুলোকে।
একের অধিক বিক্রেতা বা এটর্নির ক্ষেত্রেঃ
যদি জমিটির মালিকানা বিক্রেতার উওরাধিকারী বা ওয়ারিশের নামে থেকে থাকে সেক্ষত্রে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা থেকে ইস্যুকৃত “ওয়ারিশ সার্টিফিকেট”-এর সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। অন্যদিকে জমিটি যদি কোন অনুমোদিত এটর্নির মাধ্যমে বিক্রিত হয়ে থাকে তাহলে রেজিস্টারকৃত “পাওয়ার অফ এটর্নির” নথির কাগজপত্রের প্রয়োজন পড়বে।
জমি হস্তান্তরের দলিল প্রস্তুতকরণঃ
জমির সকল নথি, দলিল, ক্ষতিয়ান ও সকল জমি সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই শেষে আপনার আইনজীবি জমি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল দলিল প্রস্তুত করা শুরু করে দিতে পারবে। কিন্তু চাইলে, এসব দলিল নিজেদের মত করে ক্রেতা বিক্রেতারা নিজেরাই প্রস্তুত করে নিতে পারবেন।
এসব দলিল স্ট্যাম্প কাগজে প্রস্তুত করা হয় যার মূল্য ধার্য করা হয় নিদির্ষ্ট জমির বিক্রয়মূল্যের শতকরা ৩ভাগ। এই ৩%কে বলা হয় স্ট্যাম্প ডিউটি ফি।
এরপরে, আপনাকে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স, রেজিস্ট্রেশন ফী, ভ্যাট এবং অন্যান্য করের টাকা আপনার নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিয়ে দিতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রির অফিসের অধীনে ব্যাংকে রেজিস্ট্রেশন ফী পরিশোধ করতে হয় এবং রেজিস্ট্রেশনের আবেদনের সময় এর প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। এছাড়াও, ক্রেতা হিসেবে আপনাকে আপনার নিকটস্থ সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় সরকারী ট্যাক্সের মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদনঃ
জমির ক্রেতা হিসেবে আপনি চাইলে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে পারেন রেজিষ্ট্রেশনের পেমেন্টের রশিদ এবং অন্যান্য ফি প্রদানের মাধ্যমে। রেজিস্ট্রেশনের সার্টিফাইড ডকুমেন্টস এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসে ক্রেতার কাছে রেকর্ড থাকার জন্য। আসল বিক্রয় দলিল/সার্টিফিকেট তৈরি হতে আনুমানিক ছয় মাসের মত সময় লাগে।
সাম্প্রতিক জরিপে জমি তালিকাভুক্ত করাঃ
ক্রেতা হিসেবে আপনার উচিত হবে আপনার ক্রয়কৃত জমি জরিপে তালিকাভুক্ত করানো।
একজন ক্রেতা হিসেবে জমির কেনার পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে সতর্ক থাকতে হবে, নিজেকে যেকোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ রাখতে। কোন ধরণের দলিল/কাগজ সই করার পূর্বে বার বার পড়ে নিতে হবে। সব শেষে, বাড়ি কেনার আগে দক্ষ ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে কোন ক্ষয়-ক্ষতি, পানির বা অন্য কোন লাইনে লিকেজ কিংবা কীট-পতঙ্গের উপদ্রব রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো যেকোন ধরণের প্রোপার্টি কেনার ক্ষেত্রে একটা প্রাথমিক গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে। পুরো প্রক্রিয়াটি শুরুতে অনেক জটিল এবং ঝামেলার মনে হলেও সময় এবং চেকলিস্ট হাতে তা নিমিষেই সহজ হয়ে যাবে।